মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২১ অপরাহ্ন

‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’

বিডিনিউজ : একাত্তরের সাতই মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল ছিল ঢাকার রাজপথ। এরই মধ্যে স্বাধীন দেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়লো বাংলার আকাশে। পাঠ করা হলো স্বাধীনতার ইশতেহার, বাজলো জাতীয় সংগীত।

বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনের নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে চেয়ে গোটা জাতি। নেতা কি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? কি নির্দেশ তার? অন্যায়-অবিচার-শোষণের বিরুদ্ধে জনতার সংগ্রাম এবার কোন পথে? চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় মুক্তিপাগল সংগ্রামী জনতা।

একাত্তরের সাতই মার্চের বিকালে রেসকোর্সের ময়দানে মঞ্চ তখন প্রস্তুত, সবাই অধীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর নির্দেশ পেতে। আন্দোলন এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় রেখেই তেসরা মার্চ পল্টনের ছাত্র সমাবেশে বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।

একদিকে আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার চাপ; সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে ছাত্র নেতাদের চাপ, অন্যদিকে আলোচনার পথও খোলা রাখা হয়েছিল।

সাতই মার্চের কর্মসূচির আগে ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেন শেখ মুজিব। ৬ মার্চ রাতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গেও কথা হয় তার।

৭ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্র নেতাদের ভিড়। দুপুর ২টার দিকে আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদসহ নেতাকর্মীদের নিয়ে শেখ মুজিব তার বাড়ি থেকে রওনা হন সভাস্থলের উদ্দেশ্যে।

ঢাকা সেদিন পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সে সময় রেসকোর্স ময়দান নামেই পরিচিত ছিল।

মঞ্চে সকাল থেকেই গণসংগীত বাজছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন- মানুষের মধ্যে এমন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। লাঠি, ফেস্টুন হাতে উত্তপ্ত স্লোগানে পুরো সমাবেশ এলাকা মুখর।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স মাঠে যে ভাষণ দিয়েছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, সেখানেই এসেছিল স্বাধীনতার ডাক।

রেসকোর্সের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমজাদ আলী রেকর্ড করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত নির্দেশনা- “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে কর্মরত কয়েকজন মুক্তিকামী বাঙালির বীরত্বে সেদিন রক্ষা পেয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ- সাতই মার্চের ভাষণের ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভিডিও টেপের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার, যিনি সে সময় ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র বিভাগের ক্যামেরা সহকারী।

মাত্র তিন ফুট দূরে দাড়িয়ে আমজাদ আলী রেকর্ড করেন বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। সেদিনের কথা মনে করে তিনি বলেন বলেন, “আমরা সকাল ৭টার মধ্যে মাঠে পৌঁছে যাই। এত সকালে গিয়েও দেখি মাঠ কানায় কানায় ভর্তি।

“কালীমন্দির, হাই কোর্ট, ঢাকা ক্লাব ও টিএসটি পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ। অনেক সমাবেশে বসা নিয়ে সমস্যা হয়, কিন্তু ওইদিন কে কোথয় বসবে, কাউকে কিছু বলতে হয়নি। সবাই সুষ্ঠুভাবে বসে পড়েছে।”

আমজাদ আলী বলেন, “বঙ্গবন্ধু বীরের মত সিড়ি ভেঙে মঞ্চে উঠলেন, ডায়াসে গেলেন, কারও দিকে না তাকিয়ে কোন ধরনের স্লিপ না নিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন। ননস্টপ কথা বলে গেলেন।

“স্বাধীনতা, আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কী সিদ্ধান্ত দেবেন, কী নির্দেশনা দেবেন সেজন্যই ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা। বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।”

সেদিন ঢাকার বাতাসে নানা ধরনের গুজব উড়ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা সকালে মাঠে যাওয়ার পর গুজবের কথা শুনছিলাম- মঞ্চ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে, সমাবেশ শেষ হলে বের হওয়ার সময় লোকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো ভয়-ভীতি, গুজবের তোয়াক্কা করেননি।”

সেদিন বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ খুব কাছে বসে শুনেছিলেন বগুড়া সদরের শাখারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী সরদার।

সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “আমি তখন ক্লাস টেনে। তৎকালীন বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় আসছি। তিনি বললেন,  ‘সমাবেশ আছে চল যাই’। আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল।

“আমরা আগের রাতে কার্জন হলে ছিলাম। সকাল সাড়ে ৯টার দিকেই মাঠে চলে গিয়েছিলাম। ভাষণ শুনব, আর বঙ্গবন্ধুকে একটু দেখব। তাই সামনের দিকে বসতে আগেই উপস্থিত হই।

“গিয়ে দেখি আমাদের আগেই বহু মানুষ সেখানে। ভোর থেকেই আসতে শুরু করেছে মুক্তিকামী বাঙালীর স্রোত। বঙ্গবন্ধু যেখানে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখান থেকে প্রায় দুইশ গজ দূরে বসার জায়গা পেয়েছিলাম।”

বগুড়া সদরের শাখারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী সরদার একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকার্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ খুব কাছে বসে শুনেছিলেন
ইয়াকুব আলী সরদার
বগুড়া সদরের শাখারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী সরদার একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকার্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ খুব কাছে বসে শুনেছিলেন ইয়াকুব আলী সরদার

ইয়াকুব আলী বলেন, “বঙ্গবন্ধু যখন আসেন, তখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে সমাবেশস্থল গমগম করছে। সময় নষ্ট না করে বক্তব্য শুরু করেন তিনি। সাথে সাথে পুরো এলাকা নিস্তব্ধ, সব শ্লোগান থেমে গেল। সবার মনোযোগ বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে।

“ওই সময় ভাষণ শোনার আগ পর্যন্ত ঢাকায় যাদের সঙ্গেই কথা বলেছি, সবার মনে ছিল একটাই জিজ্ঞাসা – বঙ্গবন্ধু কী নির্দেশনা দেবেন, তিনি কী অর্ডার দেবেন।”

পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি রমনার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) থেকে রিলে করে শাহবাগে বেতার ভবনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সে অনুযায়ী সব প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন বেতারকর্মীরা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা বাতিল করা হয়।

বেতারের জন্য ওইদিন যারা ভাষণটি রেকর্ড করেছিলেন, তাদের একজন  বাংলাদেশ বেতারের সাবেক উপমহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) আশফাকুর রহমান খান।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “আমরা যখন রেসকোর্স ময়দানে যাই, তখন মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। বেলা ৩টা কিছু পরে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি পৌঁছায়। লাখো জনতার কণ্ঠে মহাসমুদ্রের গর্জন, ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার-আমার ঠিকানা/ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’।

“ঠিক সে সময় শাহবাগ বেতার ভবনের ডিউটিরুম থেকে আমাকে জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভাষণ বেতারে প্রচার করা যাবে না।”

আশফাকুর রহমান বলেন, “বঙ্গবন্ধু ততক্ষণে ভাষণ শুরু করেছেন। আমি দ্রুত তার কাছে গিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কথা জানাই। শুনে বঙ্গবন্ধু ভাষণের মধ্যেই নির্দেশ দেন, ‘মনে রাখবেন কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না।”

বাংলাদেশের জাতির পিতার ঐতিহাসিক সেই ভাষণ ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888